যাকাত কী

যাকাত আরবী শব্দ যার অর্থ পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি, বরকত, প্রশংসা, স্তুতি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়,

আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালনার্থে যাকাতযোগ্য অর্থ-সম্পদের শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ অংশ নিজের সব ধরণের হস্তক্ষেপ ও সুযোগ-সুবিধা মুক্ত করে যাকাত গ্রহণের যোগ্য গরিব-মিসকীনদেরকে পূর্ণ মালিকানা দান করাই হল 'যাকাত'।

যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। নামায যেভাবে শারিরিক ইবাদতের মধ্যে প্রথম সারির ইবাদত সেভাবে আর্থিক ইবাদতের মধ্যে যাকাত প্রথম সারির ইবাদত। কুরআন মাজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে -

তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। - সূরা বাকারাঃ ১১০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে -

তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। - সূরা নূরঃ ৫৬

সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে -

এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহা পুরস্কার দিব।

অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। - সূরা তাওবাঃ ১০৩

এছাড়া কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন ্মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মু’মিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে সালাত-যাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে।

ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী। - সূরা বাকারাঃ ১৭৭

তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। - সূরা মায়েদাঃ ৫৫

একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, ওরা হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। - সূরা তাওবাঃ ১৮

তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে। - সূরা হজ্জ্বঃ ৪১

আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন। - সূরা বাইয়েনাঃ ৫

মোটকথা, এত অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সালাত-যাকাত প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে এসেছে যে, এটা ছাড়া দ্বীন ও ঈমানের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। মুমিনের অন্তরের ঈমান সালাত-যাকাতের বিশ্বাসের ওপর এবং তার কর্মের ঈমান সালাত-যাকাতের কর্মগত বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। এখান থেকে এ বিষয়টাও অনুমান করা যায় যে, ফরয হওয়া সত্ত্বেও যারা যাকাত আদায় করে না তারা কত বড় ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার! যাকাতের সকল সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে তাদেরকে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা ও কুরআন মাজীদে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে -

আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। - সূরা আল-ইমরানঃ ১৮০

হাদীস শরীফে এসেছে -

যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভূত সম্পদ। - সহীহ বুখারী

যাকাত যাদের উপর ফরয

১. স্বাধীন হওয়াঃ গোলাম-বাঁদীর উপর যাকাত ফরয নয়।

২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়াঃ অপ্রাপ্ত বয়স্কের উপর যাকাত ফরয নয়।

৩. জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়াঃ পাগল/বুদ্ধি প্রতিবন্ধির উপর যাকাত ফরয নয়।

৪. মুসলমান হওয়াঃ অমুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত ফরয নয়।

৫. পূর্ণ মালিকানা হওয়াঃ যাতে অন্যের কোন অধিকার বা দায় নাই, তাতে যথেচ্ছা হস্তক্ষেপ ও লেনদেন করতে পারে, তার বর্থিতাংশ, লভ্যাংশের অধিকারী হয়।

৬. নিসাবঃ শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ যাকাতযোগ্য অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া।

৭. বছর পূর্তিঃ নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ এক চান্দ্র বছর বা ৩৫৪ দিন মালিকানায় থাকা। বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।

৮. মানুষের প্রাপ্য ঋণ মুক্ত হওয়া

৯. মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়াঃ মৌলিক প্রয়োজন দ্বারা উদ্দেশ্য হল,
  1. মানুষের জীবন রক্ষাকারী বস্তু যেমন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, ব্যবহার্য সামগ্রী, উপার্জনের উপকরণ ও যন্ত্রাদি, যুদ্ধাস্ত্র, বাহন, জ্ঞানার্জন-লেখালেখির বই-পত্রাদি, ইত্যাদি।
  2. পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ (যাদের ভরণ-পোষণ দেওয়া ওয়াজিব)
  3. ঋণ
উক্ত তিন ধরণের প্রয়োজনের অতিরিক্ত নামী তথা বর্ধনশীল অর্থ-সম্পদের উপর যাকাত ফরয।
যাকাতের নিসাব

১. স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব হল বিশ মিসকাল। আধুনিক হিসাবে সাড়ে সাত ভরি।

২. রুপার ক্ষেত্রে নিসাব হল দু’শ দিরহাম। আধুনিক হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা।

৩. প্রয়োজনের উদ্ধৃত্ত টাকা-পয়সা বা বাণিজ্যদ্রব্যের মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয় তাহলে যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে এবং এর যাকাত দিতে হবে।

৪. যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য - এগুলোর কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে এক্ষেত্রে সকল সম্পদ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।

৫. কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।

৬. বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।

যাকাতের পরিমাণ

নিজস্ব মালিকানাভুক্ত যাকাতযোগ্য অর্থ-সম্পদ নিসাব বা শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ এক চান্দ্র বছর (৩৫৪ দিন) অতিক্রম হলে তার ১/৪০ ভাগ বা ২.৫ শতাংশ (২.৫%) যাকাত দিতে হবে।

আর যদি এক সৌর বছর (৩৬৫/৩৬৬ দিন) অতিক্রম করে তাহলে ২.৬ শতাংশ (২.৬%) যাকাত দিবে।

যেভাবে যাকাত দিতে হবে

১. শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে যাকাত আদায় করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।

২. বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বিলম্ব না করা। যেদিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই যাকাত আদায় করা ফরয হয়। এরপর যখনই যাকাত আদায় করুক সে পরিমাণই আদায় করতে হবে যা সেই দিন ফরয হয়েছিল।

৩. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। যাকাত দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। তবে নিজের সম্পদ থেকে যাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলে ও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

৪. যাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে । যেকোনো ভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের মাল দেওয়া হলে মালিক যদি মনে মনে যাকাতের নিয়ত করে তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

৫. অন্যের পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যাকাত আদায় হবে না।

৬. কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারো কিছু টাকা পাওনা থাকলে যাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দিলে যাকাত আদায় হবে না। এক্ষেত্রে প্রথমে তাকে যাকাত প্রদান করে সেই টাকার মালিক বানাতে হবে। এরপর সেখান থেকে ঋণ উসূল করে নিতে পারবে।

৭. যাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। কিন্তু যদি প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।

৮. যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না।

৯. যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হল, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। যাতে সে নিজের খুশি মতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।

যাকাতযোগ্য অর্থ-সম্পদ

১. সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরয হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরয হয়।

২. সোনা-রুপার অলংকার সর্বদা বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক সর্বাবস্থাতেই তার যাকাত দিতে হবে।

৩. অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও যাকাত ফরয হয়। জামা-কাপড় কিংবা অন্য কোনো সামগ্রীতে সোনা-রুপার কারুকাজ করা থাকলে তাও যাকাতের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যে পরিমাণ সোনা-রুপা কারুকাজে লেগেছে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে তারও যাকাত দিতে হবে।

সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তদ্রূপ হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসা পণ্য না হলে সেগুলোতেও যাকাত ফরয নয়।

৪. মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্ধৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার যাকাত আদায় করা ফরয হয়।

৫. টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলে ও তাতে যাকাত ফরয হয়। হজ্বের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে তাও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে এবং নিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরয হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায় তাহলে যাকাত ফরয হবে না।

৬. দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরয।

৭. ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরয হবে।

যেসব অর্থ-সম্পদের যাকাত নেই

১. নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়।

২. গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন।

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, যেসব বস্তুর উপর যাকাত আসে না সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।

৩. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না।

৪. দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসা পণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্য দ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।

৫. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তার ওপর যাকাত ফরয হবে।

৬. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও যাকাত ফরয নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের উপর যাকাত আসবে।

যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে

১. ফকীরঃ যার নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ নাই, অথবা আছে কিন্তু প্রয়োজনীয়।

২. মিসকীনঃ যার কিছুই নাই।

৩. আমিলঃ যাকাত উসূলের দায়িত্বশীল, যদিও ধনী হয়, উপার্জন থেকে ফারেগ থাকার কারণে। তবে হাশেমী ব্যতিত।

৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যঃ কোন অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে।

৫. দাস মুক্তিঃ বুঝমান মুকাতাব দাস-দাসী তার দাসত্ব থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে।

৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিঃ তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।

৭. আল্লাহর রাস্তায়ঃ আল্লাহর পথে জিহাদ রত ব্যক্তি যিনি জিহাদকালে দল হারিয়ে ফেলায় অভাবে পতিত।

৮. মুসাফিরঃ সফরে গিয়ে যে ব্যক্তি অভাবে পড়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে (উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও)।

যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না

১. মসজিদ নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, টিউবওয়েল স্থাপন, ইত্যাদি।

২. কোন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা।

৩. মৃতের কাফন-দাফন ও তার ঋণ পরিশোধ।

৪. নিজ উর্ধ্বতন নর-নারী যেমন, বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও তদুর্ধ্বতন।

৫. নিজ অধঃস্তন নর-নারী যেমন, পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনী ও তধঃস্তন।

৬. স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে।

৭. নিজ ও নিজ উর্ধ্বতন-অধঃস্তনদের গোলাম-বাঁদি।

৮. মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত ও ঋণ অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদশালী, চাই তা যাকাতযোগ্য হোক বা যাকাত অযোগ্য হোক। যেমন, কারো মাঠের জমি আছে যা তার প্রয়োজন নাই কিন্তু তার মূল্য নিসাব পরিমাণ তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না, যদিও সে অভাবী হোক।

৯. নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদশালীর নাবালক ছেলে-মেয়ে। তবে বালেগ ছেলে-মেয়েকে দেওয়া যাবে, যদি তারা গরিব হয়।

১০. হাশেমী বংশের লোক, যদিও অভাবী হয়।